সোমবার, ০২ অক্টোবর ২০২৩, ০১:৫২ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক :
মোগল আমলে ঢাকার অভিজাত লোকদের বিনোদনের জন্য ঘুড়ি উড়ানোর আয়োজন করা হত। ১৭৪০ সালের দিকে নায়েবে নাজিম নওয়াজেশ মোহাম্মদ খানের আমলে ঢাকায় ঘুড়ি উড়ানো উৎসব একটা ঐতিহ্যে পরিণত হয়। তখন থেকেই আমাদের দেশে বাণিজ্যিকভাবে ঘুড়ি তৈরি শুরু হয়।
বাড়ির ছাদ, খোলা মাঠ থেকে আকাশে অনেক ঘুড়ি উড়তে দেখা যায়। বর্তমানকালে বিনোদনের এতসব উপকরণ থাকা সত্ত্বেও ঘুড়ি উড়ানো একেবারে বন্ধ হয়ে তো যায়ইনি, বলা যায় ভালো রকমেই টিকে আছে। বিভিন্ন দেশে ঘুড়ির বিভিন্ন রকম নামকরণ করা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে চারকোণা আকৃতির বাংলা ঘুড়ি, ড্রাগন, বক্স, মাছরাঙা, ঈগল, ডলফিন, অক্টোপাস, সাপ, ব্যাঙ, মৌচাক, কামরাঙা, আগুন পাখি, প্যাঁচা, ফিনিক্স, জেমিনি, চরকি লেজ, পাল তোলা জাহাজ, জাতীয় পতাকা প্রমূখ নাম রয়েছে।
ঘুড়ি কাটাকাটির লড়াই সারা বছরই দেখা গেলেও বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান প্রভৃতি ভারতবর্ষীয় অঞ্চলগুলোতে ঘুড়ি উড়ানোর বিশেষ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ঘুড়ির লড়াইয়ে সাধারণত একাধিক লড়াকু মাঞ্জা দেওয়া সুতা দিয়ে ঘুড়ি উড়িয়ে একজন আরেকজনের ঘুড়িকে টানে অথবা ছেড়ে কাটার চেষ্টা করেন।
বিজয়ী ঘুড়ি আকাশে উড়তে থাকে আর হেরে যাওয়া অর্থাৎ কেটে যাওয়া ঘুড়ি বাতাসে দুলতে দুলতে ভুপাতিত হয়। ভুপাতিত ঘুড়ি কুড়িয়ে নেয়ার জন্য কিশোর-যুবক-বৃদ্ধ চেষ্টা করেন।
ধারনা করা হয় যে, প্রায় ২৮‘শ বছর পূর্বে চীন দেশে সর্বপ্রথম ঘুড়ির উৎপত্তি ঘটেছে। পরবর্তীকালে এটি এশিয়ার অন্যান্য দেশ বাংলাদেশ, ভারত, জাপান এবং কোরিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও ইউরোপে ঘুড়ি খেলাটির প্রচলন ঘটে প্রায় ১৬‘শ বছর পূর্বে।
প্রথমদিকে ঘুড়ি কাগজ অথবা হাল্কা তন্তুজাতীয় সিল্কের কাপড় দিয়ে উড়ানো হতো।
ব্যবহৃত অন্যান্য উপাদানের অংশ হিসেবে ঘুড়িতে বাঁশের কঞ্চি কিংবা অন্যান্য শক্ত অথচ নমনীয় কাঠ দিয়ে তৈরী করা হয়। এছাড়াও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে সুতা কিংবা পাতলা দড়ি ব্যবহৃত হয়।
আধুনিককালের ঘুড়িগুলোয় সিনথেটিক জাতীয় পদার্থের প্রচলন রয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ঘুড়ি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচলিত। কোনটি আকারে খুব বড় ও দেখতে নয়ন মনোহর। আবার কোনটি আকারে খুবই ছোট যা দ্রুত উড়তে কিংবা প্রতিযোগিতায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
রঙ বেরঙের ঘুড়ি নীল আকাশে উড়তে দেখলে কার না ভালো লাগে। আকাশের মুক্ত বাতাশে দূর থেকে বহুদূরে উড়তে থাকা ঘুড়ি দেখে খুব ইচ্ছে করে দুরন্ত সেই কৈশোরে ফিরতে। লাটাই হাতে নিয়ে মাঠের মাঝে বা পুকুরের ধারে ঘুড়ি উড়িয়ে সারাদিন কাটাতে।
কিন্তু বর্তমান আধুনিক যুগ বা তথ্য প্রযুক্তির যুগ। স্মার্টফোন, স্মার্টটিভির কারণে বিশ্বের বিশেষত শহরের ছোট ছেলে মেয়েরা ঘুড়ি উড়াতে ভুলেই গেছে। তাদের ঘুড়ির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে বা ঘুড়ি উড়ানো শেখাতে হয়তো সময়ই থাকে না কর্মব্যস্ত অভিভাবকদের।
কিন্তু বৈশ্বি¦ক মহামারি আকার ধারণকারী প্রাণঘাতী নোভেল করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ ভাইরাসের ভয়াল থাবায় থমকে গেছে পুরো বিশ্ব। বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ দেশের মানুষ আজ গৃহবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্ধ রয়েছে স্কুল-কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল ধরণের প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা।
শুধু চালু রয়েছে জরুরী সেবা প্রদান। আর এই কোভিড-১৯ ভাইরাসের কোনও ভ্যাকসিন এখনও পর্যন্ত আবিস্কার না হওয়ায় ভাইরাসকে রুখতে জনসমাগম এড়িয়ে বা সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে ঘরে থাকাটাই একমাত্র সমাধান হিসেবে দেখছেন বিশ্বের বিশেষজ্ঞরা।
এর ফলে কার্যত সকলেই এখন অনির্দিষ্টকালের জন্য ঘর বন্দি বা লকডাউন। তাই বলা চলে সকলের হাতেই এখন অফুরান্ত সময়। তাই সময় কাটাতে সারাদিন টিভি দেখা, কম্পিউটার আর ফেসবুক চালানো ইত্যাদি করে যেন হাঁপিয়ে উঠেছে সবাই।
ঠিক তেমনি ভাবে রাজশাহীবাসিও হাঁপিয়ে উঠেছে। তাই তো পরিবার-পরিজন নিয়ে মেতে উঠেছে সেই ঐতিহ্যবাহি ঘুড়ি উড়াতে।
প্রায় প্রতিদিন-ই দুপুর থেকেই রং-বেরঙের ঘুড়ি উড়তে দেখা যাচ্ছে নির্মল বায়ুর শহর রাজশাহীর আকাশে। নির্মল বায়ুর শহরের প্রায় অধিকাংশ বাড়ির ছাদেই দেখা মিলছে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সী নারী আর পুরুষদেরকে।
তারা সবাই একসঙ্গে মেতে উঠছে নীল আকাশে ঘুড়ি উড়াতে। যা দেখে মনে হচ্ছে প্রতিটি বাড়ির ছাদে ছাদে যেন সকলে মেতে উঠেছে ঘুড়ি উৎসবে। সকলেই ব্যস্ত ঘুড়ির সুতোয় কাটাকাটি করতে কিংবা ঘুড়িকে অনেক দূরে পাঠাতে।
এ যেন নোভেল করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট দমবন্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার আর ক্লান্তি ও অবসাদ দূর করার সাথে সাথে নিজেকে সতেজ রাখার এক সুস্থ প্রতিযোগিতা। সকলেই দুঃচিন্তা আর উৎকণ্ঠায় যেন এখন ভীতসন্ত্রস্ত সময় পাড় করছে।
তারা মাঝে নির্মল আনন্দ, প্রশান্তি আর স্বস্তির ছোঁয়া এনে দিচ্ছে এই ঘুড়ি উড়ানো। আর সময় কাটাতে গিয়ে ঘুড়ি উড়াতে শেখানোর মতো সেই অভিভাবকদের আনন্দ লাভের চেষ্টা। ফলে এখন শহর অঞ্চলের ছোট ছোট ছেলে আর মেয়েদের মাঝেও তৈরি হয়েছে ঘুড়ি উড়ানো শেখার ইচ্ছেটা।
নোভেল করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ ভাইরাসের কারণে দীর্ঘ এক মাসেরও বেশি সময় ধরে ঘরবন্দি। আর কবে যে এই পরিস্থিতির উন্নতি হবে এবং বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাবে তাও বলা সম্ভব হচ্ছে না বলে উল্লেখ করে নগরের মানুষেরা বলেছেন, আগে কর্মব্যস্ততার জন্য সময়-ই পাওয়া যেত না একটু বিশ্রাম নেওয়ার বা বসে থাকার। আর এখন বাসার নানা ধরণের কাজ শেষ করেও হাতে থাকে অফুরান্ত সময়। সেই অফুরান্ত সময়গুলো অনেকেই নানা ভাবে কাটতে চেষ্টা করতে গিয়েও বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে বা হাঁপিয়ে উঠছে।
তারা আরো বলেন, অন্য সময়গুলোতে আসলে আমরা ঠিকমত আমাদের বাচ্চাদের সাথে বা পরিবারের সদস্যদের সাথে সময় দিতে পারি না। কিন্তু এখন সেই সুযোগ আছে। তাই সেই সুযোগকে কাজে লাগাতে ছেলে মেয়েসহ বাড়ির অন্য সদস্যদের নিয়ে ছাদে বাগান করার পাশাপাশি ঘুড়ি উড়াচ্ছি। এতে একদিকে যেমন ভাইরাসের ভয়কে দূরে রেখে আনন্দ করা হচ্ছে ঠিক তেমনি ওদের সাথে সর্ম্পকটাও উন্নত হচ্ছে।
এছাড়াও বাংলার ঐতিহ্যবাহি ঘুড়ি উড়ানোটা আবার নতুন করে মন রাঙিয়ে তুলছে। সেই ছেলেমেয়েরাও শিখতে পারছে এই ঘুড়ি উড়ানো বলেও মন্তব্য করেন তারা।
মহানগরীর হাতেমখান এলাকার সাব্বির হোসেন (২৭) নামের একজন ঘুড়িপ্রেমী যুবক বলেন,‘লকডাউনের ফলে প্রায় মাস খানেক হলো ঘরবন্দি। আর ভালো লাগছে না ঘরে থাকতে। সারাদিন ফেসবুক আর ইউটিউব ঘেটে ক্লান্ত। তাই ছাদে ঘুড়ি উড়িয়ে সময় পার করছি। ঘুড়ি উড়াতে গিয়ে ছেলেবেলার সেই সময়গুলোর কথাও মনে পড়ছে।’
এদিকে নগরীর শেখপাড়ার ঘুড়ি ব্যবসায়ী অসিস বলেন, “লকডাউনে ঘুড়ির চাহিদা বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিবছর গ্রীষ্মকালে ঘুড়ি উড়ানো উৎসব চললেও এত বৃহৎ পরিসরে ঘুড়ি উড়াতে আগে কখনো দেখা যায়নি। লকডাউনের কারনে মানুষ এবার ঘুড়ি উড়িয়ে সময় পার করছে। তাই বেচাকেনাও বেড়েছে সমানতালে।”
রাজশাহীতে চড়কি, ভটেং, লেজ বাল্লি, দোবাজসহ বিভিন্ন নামের ঘুড়ি আছে। প্রতি পিস ঘুড়ির মূল্য ১০ টাকা এবং বড় আকারে ঘুড়ি ২০ টাকা করে বিক্রি করা হচ্ছে বলেও জানান এই ঘুড়ি বিক্রেতা।
নগরীর তারেক নামের একজন ব্যবসায়ী বলেন, লকডাউনে সময় কাটাতে মানুষ ঘুড়ির উড়াচ্ছে। সেইজন্য ঘুড়িসহ ঘুড়ি উড়ানোর প্রয়োজনীয় সমগ্রীর চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুন।
তিনি আরো বলেন, প্রতিদিন ঘুড়ি, নাটাই ও মাঞ্জা তৈরি করতে সকাল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। সুতি সুতা ও রঙিন কাগজের চাহিদার সাথে দামও একটু বেশী তাই এবার ঘুড়ি ও নাটাইয়ের দাম একটু বেশী। প্রতিদিন কমপক্ষে ২০০টির মতো নাটাই আর ঘুড়ি বিক্রি হচ্ছে বলেও জানায় এ বিক্রেতা।
Leave a Reply