সোমবার, ২৯ মে ২০২৩, ০৪:১৭ পূর্বাহ্ন
মুক্তিযুদ্ধের উজ্জীপনায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
ওয়ালিউর রহমান বাবু
ছাত্র নেতা কাজী আরিফ ঝুঁকি নিয়ে ২৫মার্চ সন্ধার পরে বঙ্গবদ্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা ঢাকার পিলখানা ইস্টপাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) হেডকোয়াটার পৌছে দেন। প্র¯‘ত থাকা সুবেদার মেজর শওকত আলী (শহিদ) তার সহকর্মী আব্দুল মোতালেব কে সঙ্গে নিয়ে তাঁর বাড়ি থেকে বøাক সেটের মাধ্যমে সেটি প্রচার করে। পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে সহ তার অন্যান্য সহকর্মীদের ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করতে থাকে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করলে কবি বেলাল মোহম্মদ, আবুল মাসেম সন্দীপ, প্রমূখ ঝুঁকি নিয়ে চট্রগ্রাম কালুরঘাটে বেতারকেন্দ্রের রিলে ষ্টেশনে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র চালু করার পর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আব্দুল মান্নান তার বক্তব্য দিয়ে সকলকে উজ্জীবিত করলেন। কবি বেলাল মোহম্মদের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, বিদ্রোহ করা মেজর জিয়াউর রহমানকে তাঁরা সেখানে নিয়ে গেলে ২৭মার্চ তিনি এখান থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে দেশবাসীকে স্বাধীনতার সংগ্রামে অংশ নিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আহŸান জানিয়ে ভবনটি রক্ষায় স্বাধীনতাকামী এক প্লাটুন সৈনিক নিয়োজিত করেন। পাকিস্তান পš’ী সেনাবাহিনী স্বাধীন বাংরা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র (চট্রগ্রাম কালুরঘাট রিলে সেন্টার) ধ্বংশ করে দিলে এক কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার অক্ষত থেকে যাওয়ায় কয়েকজন ঝুঁকি উপেক্ষা করে সেটি সীমান্তের ওপারে নিয়ে গিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলার বাগড়া জঙ্গলে ¯’াপন করেন। স্বাধীন বাংলার বেতার কেন্দ্রের বার্তা সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা কামাল লোহানীয় দেওয়া তথ্যে জানা যায়, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার বেতার কেন্দ্রের গুরুত্ব বিবেচনা করে ভারত সরকারের কাছে পঞ্চাশ কিলোওয়াট ট্রান্সমিটারের জন্য অনুরোধ করেন। এই সহযোগিতা পেয়ে টাংগাইলের রাজনৈতিক ব্যক্তির এম হান্নান কে তথ্য ও বেতারের দায়িত্ব দিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতারের কার্যক্রমের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে, স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের অন্যতম ব্যক্তিত্ব চট্র্রগ্রাম থেকে যাওয়া কবি বেলাল মোহাম্মদ, আবুল কাসেম উদ্দিন, এ একে খান, আমুল রহমান, রাশেদুল জামান, মাবিফুজ্জামান, রেজাউল করিম, মোস্তফা রহমান, আশফাকুর রহমান, তাহের সুলতান, শাহীদুল ইসলাম, টি এইচ শিকদার, আবদুল্লাহ আল ফারুক, হাবিবুর রহমান মনি, সৈয়দ আবদুস সাকেব প্রমূখ স্বাধীণ বাংলা বেতারের কার্যক্রম নতুন করে শুরু করতে তৎপর হন। পাবনা জেলার তৎকালীন জেলা প্রশাসক প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধম সচিব নুরুল কাদের ও স্বাধীন বাংলা বেতারের বিশেষ ব্যাক্তিত্ব মুক্তিযোদ্ধার সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা এম আর আক্তার মুকুল ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বার্তা সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা কামাল লোহানীর দেওয়া তথ্যে জানা যায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের প্রস্তাবে কলকাতার বালিগঞ্জের ৫৭/৮ নং যে বাড়িটিকে অ¯’ায়ী রাষ্টপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও অন্যান্য ব্যাক্তিবর্গের থাকার ব্যব¯’া করা হয় সেখান থেকে স্বাথীন বাংলা বেতারের কার্যক্রম পরিচালনা শুরু হলো। ঢাকা থেকে চলে যাবার সময় আশফাকুর রহমান, এইচ সিকদার, তাহের সুলতান গানের টেপগুলি বালিশের মধ্যে নিয়ে যাওয়ায় সেগুলি নিয়ে সমস্যা হলেও তাহের সুলতান অনেক চেষ্টার পর সেগুলি কার্যকারী করে তুলে নিজেই অনুষ্ঠানের রেকডিং এর দায়িত্ব নিলে, সকলের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি হলো। ২৫ মে সকাল ৬:৫৯ মিনিটে “জয়বাংলা বাংলার জয় গানিটি দিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। সংকেত সংগীতের পর সকাল ৭টাই আশফাকুর রহমানের স্বকণ্ঠে ভেসে এল ‘আসসালামু আলাইকুম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। অনুষ্ঠান প্রচারিত হ”েছ মিডিয়াম ওয়েব ৩৬১.৪৪ (তিনশো একষট্রি দশমিক চুয়াল্লিশ) মিটার ব্যান্ডে ৮০০ (আটশো) কিলো হার্টসে’ সকাল ৭টা পর্যন্ত প্রথম অধিবেশন চলার পর সন্ধ্যায় ৭টা থেকে আবার দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হলো। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে রুপ নিলো। দেশের বিভিন্ন অংশের শিল্পী, বেতার কলাকৌশলী, প্রযোজক, লেখক, সাংবাদিক বিশিষ্ট ব্যাক্তি বর্গ সীমান্ত পার হয়ে স্বাধীন বাংলা বেতারের সাথে সম্পৃক্ত হলেন। চাঁপাইনবাবপঞ্জ, নাটোর, পাবনা, নওগাঁ, বগুড়া, দিনাজপুর, ও অন্যান্য অঞ্চল সহ রাজশাহী থেকে যাওয়া নাট্যকার গীতিকার মোস্তাফিজুর রহমান গামা (জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত), সংগীত শিল্পী রেজাউল সরিম রবু, মোর্শাাদ আলী (অ্যামেরিকায় কনসার্ট ফর বাংলাদেশ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন কারী শিল্পি) প্রমুখ ভূমিকা রাখতে থাকেন। স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পিরা বেতারে অনুষ্ঠান ছাড়াও অর্থসংগ্রহ শরণার্থীদের জন্য পোষাক সংগ্রহ ও মুক্তিযোদ্ধের পক্ষে প্রচারণা চালাতে থাকলেন। কোরান পাঠ, ইসলামের দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ, এম. আর আক্তার মুকুলের চরম পত্র, কল্যান মিত্রের লেখা অভিনেতা রাজু আহমেদের পরিচালনায় হাসান ইমামের পরিচালনায় জল্লাদের দরবার, অগ্নিবীণা, পিন্ডির প্রলাপ, বজ্রকণ্ঠ, রঙ্গাঙ্গনের চিঠি, পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে দর্পণ অনুষ্ঠান প্রচার হতে থাকে। আলমগীর করিব, পারভীন হোসেন, আলী জাকের, নাসরিন আহমেদ নিলু ইংরেজী অনুষ্ঠানে ভূমিকা রাখেন। জাহিদ সিদ্দিককে উর্দূ অনুষ্ঠান করার দায়িত্ব দেয়া হয়। সকাল ও রাতের অনুষ্ঠানের পাসাপাসি দুপুরের অনুষ্ঠান চলতে থাকে। বার্তা সম্পাদক কামাল লোহনীর দেওয়া তথ্যে জানা যায়, বালুগঞ্জের যে ভবনটি বাংলা বেতার পরিচালনার জন্য দেওয়া হয় সেই ভবনটিতে কেবলমাত্র অনুষ্ঠান রেকর্ডিং করার পর টেপ গুলি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বি.এস.এফ) এর সহযোগিতায় সীমান্তের কাছাকাচি নিয়ে আসা হলেও কোথা থেকে অনষ্ঠান প্রচার হ”েছ তা কঠোরভাবে গোপন রাখা হতো, যা অনেকের অজানা। চলমান এই ট্রান্সমিটারটি কখনো কখনো সকলের অগোচরে সীমান্ত পার হয়ে মুক্ত অঞ্চলে আনা হতো। একদিন কলকাতায় বন্ধ ডাকা হলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্টুডিওতে প্রবেশেরস ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে সেদিন অনুষ্ঠান চলবে না বন্ধ থাকবে তা নিয়ে সমস্যা দেখা দিলে অনুষ্ঠান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে আগেই অনুষ্ঠান রেকর্ডিং করে নেওয়া হয়। ১৬ডিসেম্বর পাকিস্তানী সৈন্যদের আত্মসমর্পনের খবরে বেতারের কার্যক্রম ¯’গিতের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এদিন বিকেল ৪:৩০০ (সাড়ে চারটায়) বিশেষ অনুষ্ঠানটি তিনি নিজেই লিখে নিজেই পাঠ করেন। প্রচার হতে থাকলো, তাক্ষনিক লেখা গান ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই বাংলা ঘরে ঘরে’। মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি সেক্টর স্বাধীন বাংলা বেতারের ভূমিকা অবদান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অনন্য এক গৌরবের।
Leave a Reply