সোমবার, ০২ অক্টোবর ২০২৩, ১২:৩৯ পূর্বাহ্ন
অনুবাদ নিবন্ধ ॥ মুমতাহহিনা খাতুন
সূরা বাকারার ১৮৭ নাম্বার আয়াতে রামাদানের গুরুত্ব সম্পর্কে বিশেষভাবে আলোকপাত করা হয়েছে। রাতের শেষভাগে সেহরী এবং প্রথমভাগে ইফতার করার কথা সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। রোজা রাখার এই বিষয়টি মূলত সূর্যদয় এবং সূর্যাস্তের ও নক্ষত্রের অবস্থানের উপর ভিত্তি করে নির্ণয় করা হয়। যখন সূর্যাস্ত যায় বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে যেমন আযান দেয়ার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে অবগত করা হয়।
ইসলামের বিকাশ লাভের পর মুসলমান ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকলে ইসলামী রাষ্ট্রগুলো সরকারিভাবে বিভিন্ন রকমের উদ্যোগ গ্রহণ করতে থাকেন এবং তা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করেন। সেগুলোর মধ্যে একটি উন্নত এবং বহুল প্রচলিত পদ্ধতি হলো কামানবাজি। যা সমসাময়িক কালে প্রচলন করা হয় এবং এর মাধ্যমে সাধারণ জনগণ সেহেরি ও ইফতার করত।
এই প্রক্রিয়াটির মাধ্যমে জনসাধারণ খুব সহজভাবে অবগত হলেও কাজটি সহজ এবং সস্তা ছিলনা। তাছাড়া এই কামান-গোলা পরিচালনা করার জন্য দক্ষ ও প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত জনশক্তি প্রয়োজন হতো। সুলতান নাছির উদ্দিনের সময়কালে কামানবাজির সমস্ত ব্যয়ভার প্রাদশিক সরকার গ্রহন করেন এবং সাংবিধানিক বিল্পবের পরে কামানবাজির এই বিভাগটি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে চলে যায়।
কিন্তু আহমদ শাহ‘র সময়কালে সামানী শাসকগণ ইরানে আক্রমন দখল করলে এই কামানবাজি সমস্যার সম্মুখিন হয়। কেন্দ্রিয় সরকার সমস্ত রাজস্ব যুদ্ধের ব্যয় করেন এবং এই কাজে নিয়োজিত সকল কর্মচারীকে যুদ্ধের কাজে লাগানো হয়। রেজা শাহ‘র শাসন আমলে কামানবাজির সমস্ত ব্যয়ভার ও দায়িত্ব সেনাবাহিনীর হাতে অর্পন করা হয়। অতপর ১৩১০ শামসী সালের দেই মাসে (ইরানি মাসের নাম) প্রাদশিক সরকার পূণরায় ক্ষমতায় ফিরে আসলে নিয়ম শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন।
আনুসাঙ্গিক বিষয়বলী মাথায় রেখে প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। ১৩১৯ শামসী সাল পর্যন্ত ইরানে এই প্রথা চালু ছিল। ১৩২০ সালে ইরানে আযান দেওয়ার প্রথা চালু করা হয় এবং ১৩২২ শামসী সালে রেডিও তে আযান সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
এই প্রবন্ধটিতে ইরানের জাতীয় গ্রন্থাগার এ সংগৃহীত বিভিন্ন নথি, দলিল ব্যবহার করা হয়েছে। কামান ব্যবহারের পদ্ধতি বিশ্লেষণ রামাদান মাসে সরকারি পদক্ষেপসমূহ, সমস্যাসমূহ এবং এর থেকে পরিত্রানের পদক্ষেপ সমূহ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
রামাজান মাসে রোজা রীতিনীতি পর্যলোচনা :
শরীয়াতের দৃষ্টিতে সিয়াম শব্দের অর্থ বিরত থাকা। পারিভাষিক অর্থে পানাহার ও খাদ্য ও কিছু নিদিষ্ট কাজ থেকে নিজেকে সংযত ও বিরত রাখা। ফজর এর পূর্বমূহুর্ত থেকে শুরু করে সূর্যাস্তের অর্থাৎ মাগরিব পর্যন্ত এই সকল কাজ থেকে সম্পূর্ন বিরত থাকার ব্যাপারে হাদিস ও ফিকাহ গ্রন্থসমূহে পুখানুপুঙ্খভাবে বর্ননা করা হয়েছে।
যেমনটি সূরা বাকারাহ ১৮৭ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে, ‘রাতের কালরেখা হতে প্রভাতের সাদারেখা স্পষ্ট হওয়ার পূর্বমূহুর্ত পর্যন্ত পানাহার কর তারপর রাত পর্যন্ত রোজা পূর্ন করো। এছাড়াও এই রাতের কালরেখা এবং প্রভাতের সাদা রেখার বর্ণণা তাফসির ও ফিকাহ গ্রন্থসমূহে বর্ননা করা হয়েছে।
ইসলামের প্রথম দিক থেকেই ফজর ও রাতের মহিমাকে আলাদা ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। যদিও এই বিষয়ে বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে শিয়া-সুন্নি মাঝে যা আজ ও বিদ্যমান। যদিও এই বিষয়টি লেখার সাথে সর্ম্পকিত নয় তবুও এই সর্ম্পকে জানার জন্য এখানে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। তাছাড়া এই বিতর্কিত বিষয়টির নিয়ে “ফজর ও মাগরিবের” সময় নির্ধারণের মাধ্যমে সাধারণ জনগণকে সেহেরী ও ইফতারের জন্য অবগত করা হয়েছে।
বিভিন্ন আলেম-ওলামাদের ভাষণ এবং সকল গলি, ওয়ার্ডে মসজিদের আযান শুনে এই সার্বজনীন নিয়মের উপর বিশ্বাস রেখে একইভাবে রোজা রেখেছে এবং রাম্জান মাসের পরিসম্পাতি ঘটেছে। আলেম-ওলামাদের এই সকল ফতোয়া সমূহ অবশ্যই তাদের অভিজ্ঞতা এবং রাতের আকাশের নক্ষত্রের অবস্থান বিভিন্ন সময়ের ঋতুর ওপর নির্ভরশীল ছিল।
চাঁদের অবস্থান, সূর্যের উদয়-অস্ত্র ছাড়াও অন্যান্য পদ্ধতি যেমন যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম এবং এই কাজের সাথে সম্পৃক্ত সকল বিষয়ের সাথে পরিচিত ছিলেন। বিখ্যাত ব্যাক্তিত্ব ও আলেম আয়াতুল্লা মির্জা মুহাম্মদ হাসান নাইনি তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘নাতিজেয়ে এলামে ওয়া তানজিরিয়ে আলমালে’ বর্ণনা করেছেন, আকাশের দিকে দেখ! পর্যবেক্ষন কর এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্তে পৌছাও।
অধিকাংশ মানুষের কাছে ঘড়ি ছিল এবং তাদের জীবনযাপন ও ছিল সহজ-সরল সাধারন ঘড়ি থাকায় তাদেরও মধ্যে কোন সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল না। আর এই কারনে সারা বছরের সূর্যদ্বয় ও সূর্যাস্ত সম্পর্কে সকলেই অবগত ছিল এবং এর উপর নির্ভর করেই দৈন্দনদিন ইবাদাত করত।
এই কাজের জন্য যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ও মজার গল্প প্রচলিত রয়েছে যা বিভিন্ন কাওম (গোত্র)-কে আকৃষ্ট করেছিল এবং ইসলামের সূচনা হয়েছিল, ইসলামের সোনালী সভ্যতা অনেক উচুতে পৌঁছে গেছিল।
৬৩৩ কামারীতে আলফুতির ছেলে কামাল উদ্দিন আব্দুর রাজ্জাক মারুভ লিখেছেন, ঐ বছর মাদ্রাসার সামনে একটি দারমন্ডল তৈরী করা হয়েছিল। হলরুমের দরজা, দেয়াল ও মহলে নক্ষত্রপুঞ্জের নকশা (ছবি অঙ্কন) করা হয়েছিল অতি সুসজ্জিত ভাবে। মহলের ভেতরে দুইটি উন্মুুক্ত সোনালী রঙ্গের বড় গামলার মতো ছিল এবং এই গামলার দুইটির পিছনে দুটি বড় ধাতব প্রস্তর ছিল যা দেখা যেতনা।
এক ঘন্টা পর পর ঐ বৃহৎ গামলার মতো বস্তুটি উন্মুক্ত হয়ে যেত এবং ধাতব প্রস্তরটি সেখান থেকে সংকেত প্রেরণ করত। প্রতিবার যখন ধাতব বস্তুটি উন্মুক্ত হতো, একটি করে খিলান খুলে যেত। দরজাগুলো যখন ঘন্টা বাজাতো তখন ঘন্টার তারগুলো ধাতব প্রস্তরটির সে গামলার উপর বাড়ি দিত, তখন দরজাগুলো তাদের নিদিষ্ট স্থানেই উন্মুক্ত হতো (বাজতো)।
এই ঘন্টা ধ্বনির মাধ্যমে সূযাস্ত এবং সূর্যদ্বয় অর্থাৎ এই পদ্ধতির মাধ্যমে সেহেরী ও ইফতার সম্পর্কে জনসাধারণকে অবগত করা হতো এবং ঘন্টাধ্বনির মাধ্যমে মুয়াজ্জিন আযান দিতেন। ইরান একটি ইসলামি শাসন ব্যবস্থা ভিত্তিক রাষ্ট্র এবং ইরানে ঠিক একই পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে সেহেরী ও ইফতারসহ ফজর ও মাগরিবের আজান ও নামাজের সময় নির্ধারন করা হতো।
কিন্তু আযান দেওয়ার এই বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে সময় নির্ধারন করা সঠিক ও সহিহ ছিলনা। কেননা প্রতিটি মহল্লায়, গ্রামে, শহরে মসজিদ ছিলনা। যদিও কোন কোন স্থানে মসজিদ ছিল কিন্তু উচ্চ শব্দ বিশিষ্ট মাইক ছিলনা। যার কারণে আযান সকল মানুষের কাছে একইভাবে পৌছাতো না, মাইকের ধ্বনি কয়েক মিটারের বেশী দূরে পৌছাতনা। আর এই বিশেষ সমস্যার কারনে সকল শহর ও গ্রামে, মহল্লায় জনসাধারণ রামাদান মাসে সঠিক ও নির্ধারিত সময় সম্পর্কে অবগত হতে পারতনা।
এই বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়ার জন্য তারা অন্য রাস্তা সম্পর্কে চিন্তা করছিল। সে সময় অনেকের পিড়াপিড়ির কারণে রামাদান মাসে সঠিক সময় নির্ধারন করার তাগাদা দেয়া হচ্ছিল। কারন রামাদান মাসের রোজা রাখার গুরুত্ব অনেক বেশি ছিল। অধিকাংশ মানুষ নামাজ না পড়লেও রোজা রাখত।
বিখ্যাত কবি ও হৃদয়গ্রাহী লেখক আবদুল্লাহ মোস্তফা তেহরানের রামাদান মাসের আনুষ্ঠানিকতা সম্পর্কে তার বিখ্যাত গ্রন্থ “সারহে জিন্দেগী-মান” সম্পর্কে বলেছেন, বিশেষ করে গ্রীষ্মকালের রামাদান মাসগুলোতে সকলে রাত হতে ভোর পর্যন্ত জেগে থাকত এবং এই কাজটি অতি মর্যাদাসম্পন্ন ছিল।
কেউ কেউ এই রাতগুলোতে ভোর পর্যন্ত ইবাদাত-বন্দিগীরী আবার দোয়া-দরুদ, আবার কোরআন তেলওয়াত করত। সেহেরী খেয়ে যোহর পর্যন্ত ঘুমাতো যেন রোজার প্রভাবটা কম পড়ে।
এদের মধ্যে এক শ্রেণীর লোকজন ছিল যারা সারারাত জুয়া খেলে রাত জেগে থাকত তাদের ভাষ্য মতে, যদি আমোদ-প্রমোদে মসগুল না হয়, তাহলে নিশ্চিত রাতে ঘুমিয়ে যাব আর দিনের বেলা ঘুম আসবেনা।
যার ফলে রোজা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। এই শ্রেণীর লোকেরা অভিজাত পরিবারের ছিল কিন্তু তারপরেও যে কোন মূল্যে তারা রোজা রাখত। যদি কোন ব্যাক্তি রোজা না রাখতে চাইত কিন্তু তারপরেও কোন সুযোগ না থাকায় নিরুপায় হয়ে সবার সাথে তাল মিলিয়ে রোজা রাখা রাখত।
মুস্তাফি এই বিষয়ে আহমেদ মনশুর কথা নকল করে বলেন, “আমি আমার ভাইয়ের সাথে সারারাত মজলিসে ছিলাম, যার কারনে সেহেরী খেতে পারিনি এবং রোজা না রেখেই বাড়িতে ফিরে আসি এবং আমাদের রোজা না রাখার খবর আমাদের বাড়িতে পৌছে গেছিল! যখন বাড়িতে প্রবেশ করলাম মা আমাদের ধরে ফেললেন।
এরপর কিছুদিন আমাদের সাথে অতি অদ্ভুত আচরন করলেন, এমনকি চাকর বাকরদের ও আদেশ দিলেন যেন আমাদের থেকে দূরে থাকে। আমাদের খাবার ঘরের মধ্যে রেখেই পালিয়ে যেত। আমাদের থালাবাসন গুলোও আলাদা করে দিয়েছিল।
পরবর্তীতে আমাদেরকে তওবা করিয়ে নিয়েছিল এবং এরপরেই আমাদেরকে বাড়ির সদস্য হিসেবে কবুল করেন। পরবর্তী রাতগুলো ছিলাম ইবাদাত এর মধ্যে দিয়ে কখনো বা ইবাদাত ছাড়া”।
সে নিজেই একজন আলেম ছিলেন। ঘুমন্ত ব্যাক্তিদের সেহেরী সময় জাগ্রত করার জন্য গরমকালে রাত জেগে কাটাতেন। ছাদে যেতেন এবং উচ্চ স্বরে কোরআন তেলয়াত, দোয়া মোনাজাত করতেন।
এইভাবে প্রতিবেশীদের সেহেরীর জন্য জাগ্রত করতেন এবং এক সময় প্রতিবেশীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, যারা রাত জাগরণ করে বা অন্যেও চেয়ে দ্রুত ঘুম থেকে উঠে তারা যেন দরজায় কড়া নাড়ার মাধ্যমে অন্যদের জাগ্রত করে।
এছাড়াও কিছু মানুষ নেকির উদ্দেশ্য মহল্লার গলিতে গলিতে যেত এবং ধর্মীয় কবিতা পাঠ করার মাধ্যমে সকলকে জাগ্রত করত।
রেজাশাহ এর শাসন আমলে তেহরানে ও কিছু যুবকরা এই পদ্ধতিতে জনসাধারণকে জাগ্রত করত।
অন্যরা এর প্রশংসা করে বলেছেন, রামাজান মাসে ফজর এর আযানের পূর্বে মহল্লার গলিতে গলিতে কিছু যুবক যেত এবং উচ্চ স্বরে বলত- পানি আছে, আফিম, চিনি ও চা আছে। এই কথাটি বলার অর্থ মানুষকে সাবধান করা যাতে মানুষজন পানাহার থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি নেশাজাতীয় দ্রব্য থেকে বিরত থাকে আসক্ত না হয় এই রোজার সময়টাতে।
রামাদান মাসে তোপ-কামানবাজি:
পবিত্র রামাদান মাসে এই রকম বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে সবচেয়ে উন্নত ও বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি ছিল তোপ-কামানবাজি। এই বিষয়টি সম্পর্কে অনেক গল্প, কাহীনি প্রচলিত আছে। বই ও প্রবন্ধ লেখা হয়েছে। এই রীতি রেওয়াজটি ইসলামের অধিকাংশ রাষ্ট্রে প্রচলিত ছিল। অনেকগুলো রীতি রেওয়াজ পদ্ধতির মধ্যে এই পদ্ধতিটিকে যুক্তিযুক্ত বলে মেনে নেওয়া হয়।
মিসরের সুলতান মুহাম্মদ আলী (১৭৬৯-১৮৪৯) ১৮০৪ সালে মিসর সালতানাতের নায়েবে অধিষ্ঠিত হন এবং ওসমানিরা তাকে পদচ্যুত সিংহাসন দখল করে নেন। পরিক্ষা স্বরুপ একটি তোপ ক্ষেপনাস্ত্র জামার্নী থেকে নেওয়া হয়েছিল এবং রামাদান মাসে সূযাস্তের কাছাকাছি সময়ে ক্ষেপনাস্ত্রটিকে চালানোর অর্থাৎ কামানবাজির নির্দেশ দেওয়া হয় জনসাধারণকে সঠিক সময় সম্পর্কে অবগত করার জন্য।
তারপর থেকে মিসরসহ বিভিন্ন ইসলামী রাষ্ট্রসমূহে অতি সুসৃঙ্খলভাবে কামানবাজি প্রথার প্রচলন করা হয়। ইরান নিজেও এই প্রথার বহুল প্রচলন ঘটায়।
এরপর থেকে এই কামানের শব্দের মধ্যে দিয়েই জনসাধারণ অতি নিরাপত্তারও সন্তুষ্টির সহিত সেহেরী ও ইফতার করত। জমিন থেকে মহাশূন্যে ছোড়া হতো এই কামান যাতে করে সকলে কাছে এর ধ্বনি পৌছে যায়।
কিন্তু এই কামানবাজির এই পদ্ধতিটি মোটেও সহজলভ্য ছিলনা এবং ব্যয়বহুল ছিল। আবার এই কাজে নিয়োজিত হবার পূর্বে সামরিক প্রশিক্ষনের প্রয়োজন হতো। তোপ, কামান, গুলিসহ আনুসাঙ্গিক বিষয়গুলোর পরিচিতি থাকার একটা ব্যাপার ছিল। কামান সত্যিকার অর্থে একটা যুদ্ধের হাতিয়ার ছিল।
সেহেতু এর ব্যবহার ছিল কঠিন এবং ভয়াবহ। কামানের গুলিগুলো বড় ও ভারী হওয়ায় অনেক দূর থেকে ছোড়া হতো আর এই রকম বহু কারনে এই কাজের জন্য শক্তিশালী ও সবল কর্মচারীর প্রয়োজন পড়ত। প্রথমের দিকে এইটাকে সরকারি মালিকানায় যুদ্ধের সরঞ্জাম এর সাথে রাখা হতো।
ইরানের বিভিন্ন প্রদশে শহরগুলোতে রামাদান মাস ছাড়াও জাতীয় দিনগুলোতেও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এই কামানবাজির আয়োজন করা হতো। আর এর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে কিছু সংখ্যক দক্ষ, সবল কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হতো। তাদেরকে যাবতীয় কার্যাবলী ও নিয়মকানুন সম্পর্কে প্রশিক্ষন দেওয়া হতো।
সাংবিধানিক বিল্পবের পর ১২৮৫ শামসী ১৪ মুরদাদ সংবিধান জারি করা হয়। প্রশাসন এরপরেও এই প্রথা চালু রেখেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক গোলযোগ, দাঙ্গা, ফ্যাসাদের কারণে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর প্রভাব পড়েছিল এবং সকল প্রদেশের উপর বিশেষভাবে নিরাপত্তা বিধান করা হয়েছিল। বর্ননাকারীর মতে কঠিন সমস্যা ও পরিস্থির মধ্যে দিয়ে এই প্রথা চালু রাখা হয়েছিল।
শাসক নাছের উদ্দিন শাহ এর সময়কালে কামানবাজি অতি জাকজমক ভাবে করা হতো। এর সমস্ত খরচ রাষ্ট্র কতৃর্ক বহন করা হতো। এই কাজে নিয়োজিত সমস্ত কর্মচারী ছিল সরকারি বেতনভুক্ত। সে সময় রামাদান মাস ছাড়াও ঈদসহ সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং শাহ এর জন্মবার্ষিকীতে সরকারিভাবে কামানবাজীর আয়োজন করা হতো।
এরূপ ধারাবাহিকতা সত্বেও কিছ শাসকগণ যেমন ফতেহ আলী শাহ তার ছেলে ও নাতীগণ এবং কাজার বংশের শাহজাদারা তাদের শাসনমালে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছিলনা এবং এই সময়কালে কামানবাজির সমস্ত ব্যয়ভার অন্যান্য কর্মকতা, কর্মচারির ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন।
১৩১২ কামারীতে বেহবানের শাসক মুনতাসির মূলক রামাজান মাসে কামানবাজির জন্য টেলিগ্রাফ এর মাধ্যমে ৭০ তুমান পাঠান। কিন্তু দূরভাগ্যক্রমে সে টাকার কারচুপি হয় এবং টেলিগ্রাফ কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার স্বীকার থেকে বিরত থাকে। পরবর্তীতে প্রাদশিক সরকারের চাপ প্রয়োগ ও গুরুত্বরোপ এর কারনে পূণরায় এর ব্যয়ভার কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে তুুলে দেওয়া হয়।
আহমেদ শাহ এর শাসনামলে সামানীগণ আক্রমণ চালায় এবং পুরো দেশ দখল করেন। এমতবস্থায় সরকারের পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। যার ফলে কামানবাজি জটিল সমস্যার সম্মুখিন হয়েছিল। কারন এমতাবস্তায় (যুদ্ধরত) সরকারের পক্ষে এর ব্যবস্থায় ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব হচ্ছিলনা।
কারণ অভ্যন্তরীন মন্ত্রণালয় যুদ্ধের সাথে জড়িত ছিল এবং যুদ্ধের খরচসহ সমস্ত আনুসাঙ্গিক খরচ সরকারের এই মন্ত্রনালয় এর উপর পড়েছিল। ১৩৩৪ সালে কামারীর রামাদান মাসের কাছাকাছি কাজবিনে সেনাবাহীনির একটি দপ্তর তৈরী করা হয় এবং সরকার ঘোষনা দেয় যে, এখন থেকে কামানবাজির সকল দায়িত্ব সামরিক বিভাগের উপর।
অর্থাৎ যেখানে যেখানে কামানবাজির আয়োজন করা হবে সেনাবাহীনি সেখানে সকল দায়িত্ব পালন করবেন। ১২৯২ শামসী সালের খোরদাদ মাসে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার পক্ষ থেকে ফরমান দেয়া হয় যে, যেহেতু ইতিপূর্বে কাজবিনে কোন সেনাবাহীনির কোন দপ্তর ছিলনা সেহেতু রমাদান মাসে, ঈদে ও বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানে কেন্দ্রিয় সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবার ১০২ তুমান ও ৬ হাজার দিনার কামানবাজির জন্য খরচ করা হতো কিন্তু বর্তমানে যেহেতু সামরিক দপ্তর কাজবিনে রয়েছে সেহেতু আসন্ন কমানবাজির সমস্ত ব্যয়ভার সামরিক দপ্তর থেকে বহণ করতে হবে।
সামরিক বিভাগ উত্তরে সরকারকে বলেন, সামরিক দপ্তর এর পক্ষ থেকে এই খরচ বহন করা সম্ভব নয়কারন এর দায়িত্ব কেন্দ্রিয় সরকারের সামরিক বাহীনির নয়। পরবর্তীতে অনেক রেসারেসি এবং চাপ প্রয়োগের ফলে সরকারের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এই বিভাগটি রাজস্ব বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
সর্বশেষে ওই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, প্রতি রামাদান মাসে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিটি শহরে একটি করে দল গঠন করা হবে এবং সেহেরী ও ইফতারের সময় কামানবাজির আয়োজন করা হবে।
গিলান সরকারের পক্ষ থেকে কেন্দ্রিয় সরকারের কাছে এই মর্মে টেলিগ্রাফ করা হয় যে, গোলাবারুদ সহ কামানবাজির সমস্ত খরচ রাজস্ব মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে।
আনন্দের বিষয় এটি ছিল যে, ১৫ শাবান ইমাম এর জন্মদিন উপলক্ষে কামানবাজির সমস্ত ব্যয়ভার গোলন্দাজ বিভাগ বহন করে।
২৫ শে রামাজান ১৩৩৪ দক্ষিন মন্ত্রণালয় থেকে রাজস্ব বিভাগে এই মর্মে চিঠি লেখা হয় যে, লোরস্তোনকে ও এর সাথে সংযুক্ত করা হোক এবং পরস্পর এর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করার ফরমান জারী করা হোক।
ইরানের সরকারি রাজস্ব বিভাগ ১৩৩৪ কামারীর কামানবাজির আকর্ষণীয় তথ্য প্রকাশ করেন। পবিত্র মাহে রামাদান, ঈদ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কামানবাজির তালিকা তুলে ধরা হলো :-
১। ১১ই রজব আমির (আঃ) এর জন্মবার্ষিকী
২। ৪ই শাবান হোসেন (রাঃ) এর জন্মবার্ষিকী
৩। ২৫ই শাবান কায়ূম (রাঃ) এর জন্মবার্ষিকী
৪। ২৭ই শাবান হযরত হুমাইনি (রহঃ) এর জন্মবার্ষিকী
৫। পবিত্র রামাজান মাসব্যাপী
৬। ঈদুল ফিতর
৭। ঈদুল আযহা
৮। ১২ই রবিউল আওয়াল মহানবী (সাঃ) এর জন্মবার্ষিকী।
উপলক্ষে কামানবাজির আয়োজন করা হয়। এটি ছিল ১৩৩৪ সালের কামানবাজির তালিকা। বলা হয়ে থাকে যে, ইরানের প্রতিটি প্রদেশে এই কামানবাজি করা হয় এবং এর খরচ প্রাদশিক সরকার ৯০০ রিয়াল করে দিয়েছিলেন।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য প্রদত্ত তালিকাটি ছিল খাপছাড়া কারন এটি পরিপূর্ন কোন তালিকা নয়। তালিকাটি থেকে হযরত আলী (রাঃ) এর জন্মবার্ষিকী বাদ পড়ে যায়। এছাড়া হযরত হোসেন (রাঃ) এবং হযরত কায়ুম (রাঃ) সম্পর্কে ভূল তথ্য দেয়া হয় এবং নুহ রোজ (ইরানী নববর্ষ) বাদ পড়ে যায়।
বিধায় এই অসাধুতা এবং বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য পূণরায় একটি র্নিভেজাল তালিকা তৈরী করা হয়। তালিকাটি নিম্নরুপঃ
১। নুহ রোজ (ইরানী নববর্ষ)
২। হযরত আলী (রাঃ) এর জন্মবার্ষিকী
৩। হযরত আমির (রাঃ) এর জন্মবার্ষিকী
৪। হযরত কায়ুম (রাঃ) এর জন্মবার্ষিকী
৫। সৈয়দ শাহদা (র) এর জন্মবার্ষিকী
৬। হযরত হামাউনির (র) এর জন্মবার্ষিকী
৭। পবিত্র রামাজান মাস ব্যাপি
৮। ঈদুল ফিতর
৯। ঈদুল আযহা
১০। ১২ই রবিউল আওয়াল মহানবী (সাঃ) এর জন্মবার্ষিকী
কামানের গুলি-তোপের মূল্য জায়গাভেদে এক এক রকম ছিল। আর এই কারনে বিভিন্ন রকমের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছিল সময়ের সাথে সাথে। পরবর্তীতে গিলান সরকার এই বিষয়টি কেন্দ্রিয় সরকারের কাছে তুলে ধরেন এবং যৌথভাবে সমাধান করেন।
পরবর্তীতে কেন্দ্রিয় সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, কামানবাজি রামাদান মাসকে কেন্দ্র করে আয়োজন করা হবে শুধুমাত্র সেহেরী ও ইফতারের জন্য। পরবর্তীতে এই নিয়ম চালু করা হয় এবং সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, কেন্দ্রিয় সরকারের তিনটি বিভাগ যথা: রাজস্ব, সামরিক ও প্রাদশিক পরস্পর সমন্বয় করে এর ব্যয়ভার বহন করবে প্রতি রামাদান মাসে।
সাংবিধানিক বিল্পবের পরে এই বিষয়টিকে সংবিধানের ধারার মধ্যে অন্তরভুক্ত করা হয় এবং ধারাবাহিকভাবে এই কামানবাজির প্রথা চলতে থাকে।
অবশেষে কালের পরিবর্তন ও আধুনিকতার ছোয়ায় অনুমানিক ১৩১৯ শামসী মাসে এই প্রথা রহিত করা হয়। যদিও কোন কোন শহরে সীমিত আকারে কামানবাজির প্রচলন ছিল। পরবর্তীতে ১৩২০ সালে প্রথমবারের মতো রামাদান মাসে সেহেরী ইফতারের আযান দেয়া হয় এবং ১৩২২ সালে শামসী মাসে রেডিওতে (রেডিও ইরান) প্রথমবারের মতো আযান সম্প্রচার করা হয়। আর এরই মধ্যে দিয়ে ইরানের এক ঐতিহ্যের অবসান ঘটে।
মূল লেখক : ড. এলহাম মালেকজাদে
(ফার্সি ভাষায় লিখিত মূল নিবন্ধটি কে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে)
Leave a Reply