মঙ্গলবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৩, ১১:১৯ পূর্বাহ্ন
আল বশরী সোহান
আজ টানা ১৭ দিন পর বাড়ির দরজা খোলা হল, তাও পূর্বদিকের দরজাটা। মেন দরজা উত্তর দিকে। ১৭ দিন আগে মেন দরজাটা খোলা হয়েছিলো। দমকল কর্মীরা এসেছিলো তপনের লাশ নিতে তাই। তপনের লাশ যাবার পরে এ বাড়ি থেকে কেও আর যায় নি আসেও নি। সে দিন বসির মেম্বার তো বাড়ির দুই গেটে বাহির থেকেই তালা মেরে দিয়েছিল। যেনো মরে গেলেও এ বাড়ি থেকে কেও বের না হয়। কি যেনো ভেবে, না কারো অনুরোধে পরের দিন নিজেই এসে তালা খুলে গেলো আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলে গেলো যে কোনো প্রয়োজনে উনার নাম্বারে ফোন দিতে। বসির মেম্বারের কথা শুনে আর কান্না থামাতে পারলো না কেও।
তপনও অনেক জনকে নাম্বার দিয়ে বলেছিলো যেকোনো প্রয়োজনে ফোন দিতে। আজ তপনেরই বাড়িতে একই কথা মেম্বার বলে গেলো। অন্যান্যদের মতই মেম্বারও প্রায় ফোন দিতো তপনকে। ফোন দিলেই দু চারটা খাবারের পুঁটলি নিয়ে ছুটতো সবার কথা অমান্য করে। ফিরতো আবার আধাঘণ্টা বা এক ঘণ্টা পরে।
তপন মারা যাবার পরেও ফোন আসতো। রিসিভ করে শুনতাম কোথায় যেনো কত পরিবারের অবস্থা খুব শোচনীয়। কথা বলার মতো বাক্য পেতাম না খুঁজে।ফোনটাকে চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দি। কারণ ঐ ফোনের রিংটোনের কাজী নজরুলের ’চল… চল… চল…’ কবিতাটা তপন হারাবার ব্যাথা আরো বাড়িয়ে দিতো।
অনেক ভয়ে ভয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় উঠলাম। নিজের অজান্তেই পা কাঁপছে। চোখও শুনছে না কথা। ঝরঝর পানি ঝরেই চলেছে। চারিদিকে নিস্তব্ধতা। এই পৃথিবী আর আগের পৃথিবী নেই। বদলে গেছে পুরোটায়। রাস্তায় মানুষজন দু এক জন।
যদিও সরকার ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ এখন সম্পূর্ণ করোনা ভাইরাসের ঝুঁকি থেকে মুক্ত। তবুও নেই মানুষের আনাগোনা। যারা রাস্তায় বেরিয়েছে তারা আবার একজন আরেক জনের দিকে এমন ভাবে দেখছে যে মঙ্গলগ্রহের কোনো প্রাণী হয় তো।
হাটতে হাটতে পুলিশ ফাঁড়ির পেছনের রোড় ধরে এগোচ্ছি। ইকরাম সাহেবের বাড়ির দেয়ালে লিখা “Stay home“। এলাকার দেয়ালে যত লিখা সব লিখেছিলো বাদল। মানুষকে ঘরে রাখতে নিজেই ছুটতো মানুষের দারে দারে তাই তো সেই আছে কবরে। তপন যাবার ৪ দিন পরে বাদলও চলে গেলো। শুনেছিলাম যে বাদল, সুজন, কাইয়ুম, ধানেশ না কি তপনকে শ্মশানে নিতে চেয়েছিল দাহ করার জন্য। পুলিশ নাকি দেয় নি। বাদল মরার সময়ও এলাকার ছেলেরা ওর লাশ কবর দিতে চাই পুলিশ তাও দেয় নি।
পুলিশ ফাড়ি পুলিশ শূন্য। মসজিদ মানুষ শুন্য। মন্দিরের যতিশ ঠাকুর ব্যাতিত কেও না কি যাওয়া আসা করে না। মসজিদ মন্দিরের মাঝে ১০০ ফিটের দূরত্ব।এই একমাস না কি যতিস ঠাকুর আর হেলাল মোল্লায় মিলেই না কি এই দুই উপাশনালয়ের দেখভাল করেছে। মানুষ জন না থাকলেও দিনে পাচবার আজানে কোনো কমতি করেন নি মোল্লা সাহেব। মন্দিরের মসজিদের ভেতর, আশপাশ, মন্দিরের প্রতিমা কোনো যায়গায় নেই কোনও ধুলাবালির ছাপ। পাশের বাগানেই দেখা মিল্লো দুই ধর্ম গুরুর।
হেলাল সাহেব কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলো,
-‘বাড়ির কি অবস্থা…?’
বললাম ‘সব ঠিকঠাকই আছে’।
লম্বা শ্বাস নিলো ঠাকুর মশায়।
লেখক : শিক্ষার্থী (কওমী, চতুর্থ বর্ষ), জামিয়া রফিকিয়া বাইতুস সুন্নাহ মাদ্রাসা, গাজীপুর, ঢাকা।
Leave a Reply